মাগুরায় ‘ভয়ঙ্কর রূপে’ রেকর্ড ভাঙতে পারে বজ্রপাত- মাগুরা সংবাদ

মাগুরা সদর

মাগুয়া সংবাদঃ

বায়ুমন্ডলে সৌর ক্রিয়াকলাপ কিংবা সোলার এক্টিভিটির আধিক্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূ-অভ্যন্তরীণ নানা কারণে আসন্ন কালবৈশাখী ও গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপে হাজির হতে পারে। ধরন ও পরিমাণে তা দেশের ইতিহাসে অতীতের সকল রেকর্ড ভাঙতে পারে বলেও আবহাওয়াবিদরা ধারণা করছেন। তীব্র বজ্রপাতের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পূর্ব-প্রস্তুতি ও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন না করলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকেও তা ইতিহাসের পাতা পাল্টে দেয়ারও শঙ্কা রয়েছে।
আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, এবছর আগামী মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে বজ্রপাতের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় হতে পারে। আর বাজ পড়া কিংবা বজ্রপাতে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর তালিকায় রয়েছে, মাগুরা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, যশোর, গাজীপুর, সুনামগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর, দিনাজপুর, নবাবগঞ্জ, বগুড়া, নাটোর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, সিলেট, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, রাজবাড়ী, সাতক্ষীরা, খুলনা, গোপালগঞ্জ, নরসিংদীসহ আশপাশের এলাকায় তীব্র বজ্রপাত হতে পারে।
বজ্রপাত নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য সোসাইটি এন্ড থান্ডারস্টর্ম এওয়ারনেস ফোরামের তথ্যানুযায়ী, মাথায় বাজ পড়ে দেশে গতবছরের সাত মাসেই (ফেব্রূয়ারি -আগস্ট) প্রাণ হারিয়েছে দুইশ’ ৪৬ জন। এর মধ্যে গত জুন (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়) মাসেই সবচেয়ে বেশি ৬৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে। আহত হয়েছে অন্তত ৯৭ জন। সংস্থাটির পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত বছরের ফেব্রূয়ারিতে ১১জন, মার্চে পাঁচ জন, এপ্রিলে ২০ জন, মে মাসে ৬০ জন, জুনে ৬৬ জন, জুলাইয়ে ৪৭ জন এবং আগস্টে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৩০ জন নারী, ছয়জন শিশু, আটজন কিশোর-কিশোরী, এবং দুইশ’ দুইজন পুরুষ। বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দেশে বিগত আট বছরে দুই হাজারের বেশি মানুষ বাজ পড়ে মারা গেছে। এর মধ্যে গত ২০১৬ সালে বজ্রপাতে সাড়ে তিনশ’ মানুষের মৃত্যু হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে বজ্রপাতে মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা তিনশ’রও বেশি। আর ২০১৮ সালে বজ্রপাতে মারা যায় একশ’ ৬০ জন। আহত হয় শতাধিক।
প্রসঙ্গত, সরকার বিগত ২০১৬ সালের ১৭ মে জাতীয় দুর্যোগের তালিকায় বজ্রপাতকে অন্তর্ভূক্ত করে। ভারতের আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছরে গড়ে তিন হাজার বজ্রপাত হয়। আর জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে বছরে গড়ে আড়াই হাজার বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে।
বজ্রপাত বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. এম এ ফারুখ বলেন, বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা তুলনামূলক বেশি হওয়ার মূল কারণ ভৌগলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর, এরপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর আর্দ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরেই রয়েছে হিমালয়, যেখান থেকে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। এই দুই ধরণের বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। দেশের উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চল বজ্রপাত-প্রবণ এলাকাগুলোর অন্যতম। কালবৈশাখী মৌসুম ও গ্রীষ্মকালে এ অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। যেসব এলাকায় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, সেসব এলাকায় যে মেঘের সৃষ্টি হয় সেখান থেকেই বজ্রপাত বেশি হয়।
জানা গেছে, বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা দিতে প্রায় ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালে দেশের আটটি স্থানে ‘লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর’ স্থাপন করা হয়। বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ এসব রাডার ঢাকা, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা এবং পটুয়াখালীতে স্থাপন করা হয়। কিন্তু কারিগরি দক্ষতার অভাবে রাডারগুলো কোনও কাজে আসছে না।
এ বিষয়ে রাডার বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম জানান, বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়া এবং রাডার পরিচালনা বা তথ্য সংগ্রহের দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল আবহাওয়া অধিদপ্তরে নেই। ফলে, রাডারগুলোকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের রাডার কোম্পানি প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিলেও এখন তাদের এজেন্টদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অযতœ-অবহেলায় রাডারগুলো নষ্ট হচ্ছে। রাডার স্থাপনের আগে বলা হয়েছিল, বজ্রপাতের ১৫ মিনিট আগেই তথ্য জানা যাবে। মোবাইল ফোনে ১৫ মিনিট আগেই ওই এলাকার মানুষকে বজ্রপাতের তথ্য জানিয়ে দেয়া যাবে। ভারতের উড়িষ্যায় এ প্রযুক্তিতে প্রাণহানির সংখ্যা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
বজ্রপাতের সময় করণীয় : সেভ দ্য সোসাইটি এন্ড থান্ডারস্টর্ম এওয়ারনেস ফোরামের জানিয়েছে, যে স্থান বা বস্ত যত উঁচু সে স্থান মেঘের তত সন্নিকটে থাকায় ওখানেই বজ্রাঘাতের শঙ্কাও তত বেশি হয়। তাই বাড়ির ছাদ কিংবা উঁচুস্থানে অবস্থান করলে দ্রুত সেখান থেকে নেমে নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। ঘন কালো মেঘ বা ঝড়ো মেঘ দেখলেই সাবধান হতে হবে এবং বৃষ্টি শুরুর আগে নিরাপদস্থানে আশ্রয় নিতে হবে। পাকাবাড়িতে আশ্রয় নেয়া বেশি নিরাপদ। তবে পাকা বাড়ি সুউচ্চ হলে সে ক্ষেত্রে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় জানালার কাছে না থাকাই ভালো। পায়ে রাবারের স্যান্ডেল থাকা এবং পানি ও যে কোনও ধাতব বস্তু যেমন সিঁড়ি বা বারান্দার রেলিং, পানির কল ইত্যাদির স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে। বিদ্যুৎ পরিবাহী যে কোনও বস্তুর স্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। পুকুর বা জলাশয়ে থাকা নিরাপদ নয়। বাড়ির বৈদ্যুতিক জিনিসপত্রের বিদ্যুৎ ও ডিসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা ভালো। এগুলো বন্ধ থাকলেও স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে। মাঠের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় থাকলে বজ্রপাতের সময় কানে আঙ্গুল দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিচু হয়ে বসে থাকতে হবে। তবে মাটিতে শোয়া যাবে না, কেননা মাটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বজ্রপাতের পরিস্থিতি তৈরি হলে গাড়ির মধ্যে থাকা নিরাপদ। তবে গাড়ির ধাতব কোনও অংশের সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.